মহানবীর সমাজসেবা এবং নবুয়ৎ


শাহ আলম বাদশা

          মানবেতিহাসের সর্বসফল এবং সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হচ্ছেন মুহম্মদ সাঃ, যিনি আমাদের মুক্তির একমাত্র দিশারী। আর  আলস্নাহর ভাষায় তিনি হলেন-----রাহমাতুল্লিল আলামিন বা বিশ্বের রহমত। ইতিহাসই তাঁর এধরণের অবস্থানকে স্বর্ণাক্ষরে লিখে দিয়েছে; যা দলমত, জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সকলেই স্বীকার করতে বাধ্য। জ্ঞানপাপী ও বিবেকহীন ব্যক্তি ব্যতীত তাঁর দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠত্বকে অস্বীকার বা অবজ্ঞা করার শক্তি কারো নেই! তবুও একজন মুসলিমের মুখে মহানবীর এমন গুণকীর্তণে অন্য ধর্মাবলম্বী অনেকেই একে পক্ষপাতিত্ব বলে অবজ্ঞা করতে পারেনকিন্তু বর্তমান বিশ্বের অন্যতম খ্রিস্টান চিমত্মাবিদ মাইকেল এইচ হার্ট যখন তার আলোড়ন সষ্টিকারী ‘‘দি হান্ড্রেড’’ গ্রন্থে মুহম্মদ সাঃ কে ‘১০০ জন সেরার মধ্যে সর্বসেরা’ বলে গর্ব করেন, তখন কী বলবেন?

          লেখক বিশ্বের একশত জন মহামানবের কর্মময় জীবনী লিখে মহানবীকে স্থান দিয়েছেন তালিকার সর্বশীর্ষে। তিনি ভূমিকায় লিখেছেন-- ‘আমার বিবেচনায় এ পৃথিবীর সবচাইতে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মধ্যে মুহাম্মদ সাঃ এর নাম তালিকার শীর্ষে স্থান পাওয়ায় পাঠক-পাঠিকাদের মধ্যে অনেকেই বিস্মিত হতে পারেন। অনেকের মনে অনেক প্রশ্ন জাগতে পারে। কিন্তু একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মুহাম্মদ সাঃ মানব ইতিহাসে একমাত্র ব্যক্তি যিনি ধর্মীয় (আধ্যাত্মিক) ও পার্থিব উভয়ক্ষেত্রেই সর্বোচ্চ সাফল্য অর্জন করেছেন।’

          হজরত মুহম্মদ সাঃ আরবের একটি সাধারণ অথচ সম্ভ্রামত্ম পরিবারে জন্মলাভ করেন। তিনি স্বশিক্ষিত অথচ নিরক্ষর ছিলেন। মানুষের মুখাপেক্ষী হয়ে কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার্জনও করেননি। তার শিক্ষক হচ্ছেন সরাসরি আল্লাহই। জন্মের আগেই  পিতার মৃত্যু আর ছয়বছর বয়সে মাতার মৃত্যুর পর তিনি চলে যান দাদার আশ্রয়ে। কী দূর্ভাগ্য তাঁর যে, মাত্র দশবছর বয়সে দাদার মৃত্যুতে সেখান থেকেও আশ্রয়চ্যুত হন।

          জঘন্য পাপাচারে পরিবেষ্টিত আমাদের মত কলুষিত একটি সমাজে একের পর এক আশ্রয়চ্যুতি আর অবর্ণনীয় ধকল সহ্যের পর কিশোর অপরাধে না জড়িয়ে দশবছর বয়সী একটি এতিমশিশুর পক্ষে স্বাভাবিক জীবন নিয়ে বেঁচে থাকাই তো বিস্ময়কর। অথচ তিনি জাগ্রতবিবেক এবং সততার মূর্তপ্রতীক হিসেবে সন্ত্রাস ও জুলুমসমৃদ্ধ দেশ-জাতির সংস্কার এবং সংশোধনের লক্ষ্যে মাত্র ১৭ বছর বয়সে গড়ে তুললেন ‘হিলফুল ফুযুল’ বা ‘সমাজকল্যাণের প্রতিজ্ঞা’ নামক নিরস্ত্র এক সমাজসেবী সংগঠন। তাঁর সমবয়সী ও সমমনা যুবকদের সংগঠিত করে তিনি জনকল্যাণে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা বা সাংগঠনিক শক্তির প্রয়োজনীয়তা তিনি তখনই উপলব্দি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে তাঁর হাদীস ‘‘ যে ব্যক্তি সংগঠন বা দল থেকে এক বিঘত পরিমাণ সরে গেলো, সে যেনো তার গর্দান থেকে ইসলামের রজ্জুই খুলে ফেললো’’ স্মরণযোগ্য। তাঁর সংগঠনের মূল পাঁচটি লক্ষ্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল- গোত্রে-গোত্রে ঝগড়া, মারামারি এমনকি যুদ্ধ বন্ধ করা, নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষকে রক্ষা ও সহায়তা করা, সমাজে নৈতিকতা ও সুকুমারবৃত্তির প্রসার ঘটানো ইত্যাদি।

          তখনও তিনি নবুয়ত পাননি। তার সামনে কোন নির্দিষ্ট আর্দশও ছিল না। তবুও তিনি জঘন্য সমাজের একটি উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা হিসেবে তার নিজস্ব বুদ্ধি-বিবেচনা প্রসূত এবং মনগড়া পদ্ধতিতে দেশ-জাতির কল্যাণে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন।  নিজে অত্যমত্ম সৎ হিসেবে প্রসিদ্ধ হলেও তিনি কিন্তু গোটা সমাজব্যবস্থার আমূল কোন পরিবর্তন করতে পারেননি। তবে বিচ্ছিন্নভাবে জনকল্যাণে অবদান রেখেছেন মাত্র। মানুষের অর্থসম্পদ আমানত রাখা, অসহায়-দুঃখীদের সর্বপ্রকার সাহায্য করা, রাসত্মা-ঘাট, প্রতিষ্ঠান, ঘরবাড়ীনির্মাণ এবং সংস্কার করে দেয়া, সামাজিক বিবাদ মীমাংসাসহ নানারকম সামাজিক কাজ করে তিনি বিপুল প্রশংসাও কুড়িয়েছেন। আল-আমিন (বিশ্বস্ত) আস্-সাদিক (সত্যবাদী) ইত্যাদি উপাধিও কম পাননি।  

         
          কিন্তু তার মনের সুপ্ত বাসনা অনুযায়ী প্রকৃত স্রষ্টাকে খুঁজে পাবার মাধ্যমে স্রষ্টার নির্ধারিত পথেই দেশ ও জাতিগঠন এবং কল্যাণরাষ্ট্র পরিচালনা করার দিশা তখনো তিনি পাননি। তবুও তিনি বিরত হননি বরং ব্যাপক সমাজসেবা, একেশ্বরবাদী ধর্মচর্চার পাশাপাশি আলস্নাহর সন্ধানে সবসময় ব্যাপৃত থাকতেন। হেরা গুহায় বসে কাবামুখী হয়ে আলস্নাহকে ডাকতেন এবং জাতির মঙ্গল কামনা করতেন। অবশ্য এর মধ্যেই তিনি চাচা আবু তালিবের
সাথে ব্যবসায় জড়িত হওয়ার পাশাপাশি ২৫ বছর বয়সে হজরত  খাদিজা(রাঃ) কে বিবাহ করার কাজটি সম্পন্ন করেন। ধনাঢ্য ব্যবসায়ী খাদিজার (রাঃ) ব্যবসায়ে জড়িত হবার পর আর্থিক স্বচ্ছলতা আসায় সমাজকল্যাণ আর জনকল্যাণে তিনি দু’হাতেই অর্থসম্পদ বিলানোর সুযোগ পান। এমনকি সতী-সাধ্বী স্ত্রীর উৎসাহে (সাঃ) আলস্নাহর সন্ধানে আরও বেশি সময় ব্যয় করতে থাকেন। এভাবেই তিনি আলস্নাহর মনোনীত বান্দা হিসেবে হেরা গুহায় ৪০ বছর বয়সে নবুয়ুতলাভ করেন, যা সবারই কমবেশি জানা। প্রকৃতপক্ষে নবয়ুত লাভ মানেই হলো-পূর্ণাঙ্গ-নির্ভুল এবং মানবকল্যাণকর একটি আর্দশ হাতের মুঠোয় পেলেন, যা তিনি এতদিন কামনা করছিলেন। ফলে তিনি ইসলামের ছোঁয়ায় সম্পূর্ণ বদলে যেতে লাগলেন এবং ইসলামী সমাজব্যবস্থা বা রাষ্ট্রব্যবস্থাগঠনের লক্ষ্যে ব্যাপক জনমতগঠন, তাদের সুসংগঠিতকরণ, নিয়মিত কোরআন-হাদীসদ্বারা প্রশিক্ষণদান এবং একের পর এক আল্লাহ প্রদত্ত নির্দেশিত আমলসমুহ যেমন-নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত, ইত্যাদি পালনে অটল থাকেন।
         
          মক্কার লোকেরা তাকে অত্যমত্ম পছন্দ করতো এবং তার উপদেশ নির্দেশ মেনে চলতো। অথচ কুরআন নাজিল, নবুয়ুতপ্রাপ্তি এবং আর্দশপ্রচার শুরম্নর পর তারা হয়ে গেলেন তার চিরশক্রু। এমনকি আপনজনদেরও অনেকে তাকে প্রাণনাশের চেষ্টা করলেন। তিনি সকল বাধা পেরিয়ে হিজরত করে অনুকুল পরিবেশে চলে গেলেন মদীনায় এবং সেখানে নগররাষ্ট্র গঠনে ব্রতী হলেন। বিশ্বের সর্বোৎকৃষ্টমানের ‘মদীনার সনদও’ তিনি রচনা করলেন, যার মানবতাবাদী ও মৌলিক অধিকারসম্বলিত ধারাসমূহ ইদানীং বিশ্বের বিভিন্ন আমর্ত্মজাতি সংস্থায় অন্তর্ভূক্ত হতে দেখছি আমরা। অথচ তিনি দেড়হাজার পূর্বেই কোরআন-হাদীস মারফত মৌলিক মানবাধিকার সংক্রান্ত যা কিছু দিয়ে গেছেন, তারই সমর্থনে কিছু কিছু বৈজ্ঞানিক তথ্য-তত্ত্ব আজকাল আবিস্কৃত ও বিভিন্ন ফোরামে  সন্নিবেশিত হচ্ছে মাত্র।

          এভাবেই ৪০ বছর বয়সে যে আন্দোলন শুরম্ন করলেন ৬৩ বছর বয়সে মৃত্যুর পূর্ব পর্যমত্ম তাতে অটল থাকলেন তিনি। দীর্ঘ ২৩ বছরের সাধনা এবং আলস্নাহর নির্দেশনায় তিনি ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা, সমাজব্যবস্থা, সামরিকবিদ্যা, রাজনীতি, অর্থনীতি, ব্যবসায়নীতিসহ মানবজীবনের জন্য পূর্ণাঙ্গ একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠা করে গেলেন। অথচ নবুয়ত পাবার পূর্বে ১৭ বছর বয়স থেকে ৪০ বছর বয়স পর্যমত্ম সেই ২৩ বছরব্যাপী ‘হিলফুল ফুজুল’ নামক সংগঠনের মাধ্যমে তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেও সমাজের অনুরূপ পরিবর্তনসাধন করতে সক্ষম হননি। কারণ তখন তার সততা, উৎসাহ-উদ্দীপনা, আকাঙ্খার ঘাটতি না থাকলেও ছিলনা তার সামনে নির্দিষ্ট ও পূর্ণাঙ্গ কোন আর্দশ, যাদ্বারা সমাজপরিবর্তন হতে পারে। এ থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে, সততা থাকলেই চলবে না মানবকল্যাণে চাই পূর্ণাঙ্গ আদর্শ জীবনব্যবস্থা- যা হবে স্রষ্টা প্রদত্ত। আর সততা আর মনগড়া আর্দশ থাকলেও তাদ্বারা মানুষ পুরোপুরি উপকৃত হতে পারে না, যার প্রমাণ বর্তমান বিশ্ব। 

Comments